কারাকোরাম হাইওয়ে, পাহাড়ের পিঠ বেয়ে এগিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক সড়ক। এর সর্বোচ্চ বিন্দু হলো খুঞ্জেরাব গিরিপথ। এখানে আন্তর্জাতিক সীমান্ত ক্রসিং। যা চীন ও পাকিস্তানকে যুক্ত করেছে।

কারাকুরাম হাইওয়েকে অনেকেই বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য হিসেবে উল্লেখ করেন। এর উচ্চতা চার হাজার ৬৯৩ মিটার। পাকিস্তানের উত্তর সীমান্তে গিলগিট-বালতিস্তানের হুনজা এবং চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম শিনজিয়াং সীমান্তে এর কৌশলগত অবস্থান।

পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে ১৯৮৫ সালের চুক্তি অনুসারে এই সীমান্ত পথটি এপ্রিল মাসে চালু হয়। আবার তুষারপাতের কারণে নভেম্বর মাসে বন্ধ হয়ে যায়।

হুনজা উপত্যকায় বসবাসকারীদের ভাষায় ‘খুঞ্জেরাব’ শব্দের অর্থ হলো ‘রক্তপ্রবাহ’। উচ্চতার কারণে ওই গিরিপথে বছরের বেশিরভাগ সময় তাপমাত্রা কম থাকে। অক্সিজেনের হারও কম। তাই ওই ক্রসিংয়ে শ্বাস নেওয়া কঠিন।

তবে খুঞ্জেরায় রয়েছে টাকা উত্তোলনের জন্য এটিএম বুথের মতো টেলার মেশিন। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এই মেশিনটি বসিয়েছিল।

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডধারী এই মেশিনটি ২০১৬ সাল থেকে স্থানীয়দের, সীমান্ত কর্মীদের এবং দুঃসাহসি পর্যটকদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কারাকোরাম হাইওয়ে তার মনোরম অবস্থান এবং উচ্চ-ঝুঁকির কারণে অ্যাডভেঞ্চার পর্যটন গন্তব্য হয়ে উঠেছে।

এতে এই বিপজ্জনক রাস্তায় প্রতি বছর শত শত দুর্ঘটনাও ঘটছে।

এই সড়কটি তৈরি করতে ২০ বছর সময় লেগেছিল চীন ও পাকিস্তান সরকারের। নির্মাণের সময় ৮১০ জন পাকিস্তানি শ্রমিক এবং ২০০ চীনা শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।

পাকিস্তানের গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চলের উত্তর অংশের সুন্দর পাহাড়ি উপত্যকা হুনজা। একে ঘিরে রেখেছে গ্র্যান্ড হিমালয় এবং কারাকোরাম পর্বতমালা।

হুনজাকে ডাকা হয় পৃথিবীর স্বর্গ। এখানে অবাক করা প্রাকৃতিক দৃশ্য, পাহাড়ের হিমবাহ, পান্নার মতো সবুজ। পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে প্রবাহিত হুনজা নদী।

গোটা উপত্যকাটি ফিরোজা-নীল রঙে সেজে আছে, রূপকথার দেশের মতো। যাকে বলা যেতে পারে পাকিস্তানের মুকুট।

হুনজা নদীর উত্তর-পশ্চিমের উপত্যকাটি আড়াই হাজার মিটার উঁচুতে। ওখানে আছে শ্বাসরুদ্ধকার প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থান। যা পর্যটকদের হাতছানি দেয়।

রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ১৩ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে হুনজা উপত্যকায় যাওয়া যায়।

বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম হিমবাহ ‘বাতুরা’র দেখা মিলবে সেখানে। পর্যটকরা হুনজায় যান আলটিত এবং বাল্টিত দুর্গের দেখা পেতে। আলতিত গ্রামের আলতিত দুর্গটি পাহাড়ের পাথরের উপর দুর্দান্ত এক স্থাপত্য নকশা। এর ঠিক পেছন দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে হুনজা নদী।

৮০০ বছরের পুরানো বাল্টিত দুর্গ। এখানে থাকতেন উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী রাজকুমাররা। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগের সিল্ক রোডের অংশ কারাকোরাম। হুনজায় এই রোড নিয়ন্ত্রণ করতেন বাল্টিতের রাজকুমাররা।

হুনজা উপত্যকার গোজাল অঞ্চলে অবস্থিত আত্তাবাদ হ্রদ। এটি ২০১০ সালে একটি বিশাল ভূমিধস থেকে তৈরি হয়েছে। এর উজ্জ্বল-নীল ফিরোজা জল এটিকে পাকিস্তানের সুন্দর জায়গাগুলির একটি করে তুলেছে।

হ্রদটি অনেক পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে এবং জেট-স্কিইং, ফিশিং এবং বোটিংসহ পর্যটন ক্রিয়াকলাপ হচ্ছে।

হুনজার পবিত্র শিলা, পেট্রোগ্লিফের প্রাচীনতম স্থানগুলোর মধ্যে একটি। যে শিলাটি সিল্ক রোডের এই পয়েন্টে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সুরক্ষিত রেখেছিল। এর মাধ্যমে দুই হাজার বছর ধরে বাণিজ্যের রেকর্ড থেকে যায়।

পাহাড়ের উপর একটি পাতলা রেখা হিসেবে এখনো দেখা যায় ঐতিহাসিক সিল্ক রোড।

কারাকোরাম মহাসড়ক নির্মাণ হওয়ার পর থেকে সিল্ক রোড ধরে স্থানীয়রা এগিয়ে যান। আর এই রোড দেখতে যান পর্যটকেরা।

হুনজার লোকেরা হুনজাকুট নামে পরিচিত। সেইসাথে তাদের আতিথেয়তা এবং বন্ধুত্বের জন্যও পরিচিত।

হুনজার জনগণের আয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল পর্যটন। প্রতি বছর দেড় থেকে দুই মিলিয়ন দেশি এবং বিদেশি পর্যটক ওই অঞ্চলে যান।

এ কারণে হুনজা উপত্যকার কেন্দ্রস্থল কেরিমাবাদ শহরে পর্যটকদের জন্য অনেক স্মারকের দোকান রয়েছে। খাবার, পোশাক এবং ভ্রমণ সংস্থা রয়েছে।

উপত্যকার সাক্ষরতার হার ৯০ শতাংশ। প্রতিটি শিশু উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা নেয়। তবে এদের কেউ কেউ উচ্চতর পড়াশোনাও করে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here